শুনি একাত্তর এর গল্প
উচ্চস্বরে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত গাওয়া শুরু করল মজিদ মাস্টার –“ পাক সার জামীন শাদ বাদ, কিশ্বারে হাসীন শাদ বাদ…..”। মজিদ মাস্টার কোন ভুল করেনি।পাঞ্জাবি,পায়জামা পরেই এসেছে। মাথায় বেধে নিয়েছে পাকিস্তানের পতাকা।সে দাঁড়িয়ে আছে সোনাপুর হাইস্কুলের মাঠে। স্কুলটিকে পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্প করা হয়েছে। মজিদ মাস্টার একা আসেনি। তার সাথে আনা হয়েছে বড় মসজিদের ইমাম আকবর মিয়াকে। সামনে একটা চেয়ারে বসে আছে মেজর লিয়াকত খান। মেজর সাহেব মজিদ মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন-“ পাকিস্তান জিন্দাবাদ বোলো”। এর আগেও বেশ কয়েকবার তাকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে হয়েছে।মজিদ মাস্টার আবারও বলল।এবারে অনেক জোরে। সে শরীরের সব শক্তি ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলায় খরচ করে ফেলল। সে এত জোরে বলবে মেজর সাহেব অনুমান করতে পারেননি। তিনি দুহাতে কান চেপে ধরলেন।তারপর হাসিমুখে বললেন-“ বহুত আচ্ছা। তুম আসলি পাকিস্তানি ”
মেজর লিয়াকত তাদেরকে যথেষ্ট সম্মান করলেন। চা-নাশতার ব্যাবস্থা করলেন। একজন সামান্য স্কুল শিক্ষক হয়ে এতটা সম্মান পাবে মজিদ আশা করেনি।তাছাড়া তার বয়সও বেশি না।সবেমাত্র স্কুলে জয়েন করেছে। তার বয়সী যুবক দেখলেই নাকি পাকিস্তানি মিলিটারিরা গুলি করে মেরে ফেলে।মজিদ দেখলো সবই ভুল ধারণা। মজিদ মাস্টারের কোন ভাবেই মনে হচ্ছে না তাকে মেরে ফেলার জন্য ডাকা হয়েছে। পাকিস্তানি মিলিটারি সমন্ধে মানুষ যা বলে সবই তাহলে গুজব ছাড়া কিছু না। পাকিস্তানি মিলিটারিকে নাকি বনের বাঘও ভয় পায়। মেজর লিয়াকত সাহেব কে দেখে মনে হচ্ছে না তাকে দেখে কোন বাঘ ভয় পাবে।অমায়িক ব্যাবহার লোকটির। মজিদ মাস্টার, ইমাম সাহেব এবং মেজর লিয়াকত তিনজন সময় নিয়ে গল্প করে।দেশ নিয়ে কথা বলে। স্কুলের সামনে খেলার মাঠ। তারও পরে ফসলি জমি। সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।ধান সবে মাত্র পাক ধরেছে।মেজরের নির্দেশে সেখানে লোকজন নিয়ে আগুন লাগাচ্ছে জালাল চেয়ারম্যানের লোকজন। তারা বেশ আনন্দ নিয়েই কাজটা করছেন এটা বোঝা যাচ্ছে। একটা বেপার মজিদ মাস্টারের মাথায় ঢুকছে না। দোষ করলে করেছেন শেখ সাব। মাঠের ফসল তো দোষ করে নাই। এরা ধান ক্ষেতে আগুন দিচ্ছে কেন?
মেজর সাহেব উর্দুতে বললেন -“ এই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আছে?” মজিদ মাস্টার উর্দু কিছু কিছু বুঝতে পারে। কিন্তু বলতে পারে না। জবাব দেয় ইমাম আকবর মিয়া। ইমাম সাহেব বললেন-“ জী না স্যার।খোদার মেহেরবানি, এই গ্রামে কোন কাফের নাই।আমরা যারা আছি সবাই পাক্কা মুসলমান। সবাই পাকিস্তানের গোলাম। পাকিস্তানকে মুহাব্বাত করি।” এত টুকু বলে ইমাম সাহেব আবারও গলা ছেড়ে‘ পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বললেন।সাথে যোগ দিল মজিদ মাস্টারও। মেজর লিয়াকত বললেন-“এত ঘন ঘন ‘ পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে হবে না।আমরা খুব বেশি ভালো পজিশনে নেই।ইতোমধ্যে কয়েকটা জেলা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে গেছে।আমাদের সম্ভবতঃপিছু হটতে হবে।” ইমাম সাহেব বললেন-“একদমই চিন্তা করবেন না স্যার।দরকার হলে খোদা তালা আসমান থেকে নুরের ফেরেস্তা নামায়া দিবেন। ফেরেস্তারা ঐ কাফের মুক্তিদের বিপক্ষে যুদ্ধে নামবে। পাকিস্তানের জয় ঠেকানোর মত কেউ নাই।” নিজের কথায় নিজেই খুশি হন ইমাম সাহেব। কথা শেষ করার পরও দীর্ঘসময় তিনি হাসি ধরে রাখেন মুখে।মেজর সাহেব বললেন-“ আপনি পাকিস্তান কে অনেক পিয়ার করেন?
-“ জী স্যার। মেরা পিয়ারা পাকিস্তান।”
-“ মৌলুভি, আমরা খবর পেয়েছি আপনি হিন্দু লোকদের লুঙ্গি,পাঞ্জাবি পরিয়ে মুসলমান সাজিয়ে রেখেছেন। নিজের ছেলেকে মুক্তিযোদ্ধাদের দলে দিয়ে দিয়েছেন।মসজিদের ভেতর হিন্দু মেয়েদের লুকিয়ে রাখেন।এসব কি সত্যি?” ইমাম সাহেবের মুখের হাসি মিলিয়ে যায় সাথে সাথেই। হাসির বদলে সেখানে নেমে আসে ভয়। স্বাধারণ কোন ভয় নয়। এই ভয় অন্যরকম। এসব খবর এরা কীভাবে জানলো।সব তিনি করেন গোপনে।কারও জানার কথা না।তিনি মুখে কিছুই বলতে পারেন না।মনে মনে দোয়া কালাম পড়তে শুরু করেন। মেজর লিয়াকত আচমকা আকবর মিয়াকে কষে চড় লাগালেন।ইমাম সাহেবের বয়স ষাটের উপর।শক্ত হাতের চড় তিনি নিতে পারলেন না। চেয়ার সহ নিচে পরে গেলেন। মেজর সহজ ভঙিতে গুলি করেন ইমাম সাহেবকে। মজিদ মাস্টার এই ঘটনা সহ্য করতে পারে না। বমি করে সামনের টেবিল ভাসিয়ে দেয়।এই প্রথম বার তার মনে হয় পাকিস্তানি মিলিটারি সমন্ধে তিনি যা শুনেছেন তার কিছুই মিথ্যে না।মাথা ঘুরে নিচে পরে যায় মজিদ।
মজিদ মাস্টারকে উঠতে সাহায্য করে রাজাকার জালাল। জালাল অশুদ্ধ ঊর্দুতে বলে -“ স্যার দেরি করে লাভ নাই। এখন ভর দুপুর। চলেন দুপুরের খানা আমরা মজিদ মাস্টারের বাসায় গিয়ে খাই। মজিদ মাস্টারের ঘরে নতুন বউ।তার বউয়ের পাক ভালো।” মজিদ মাস্টারকে ওরা মেরে ফেলে না। স্কুলের উঠোনে মস্ত বড় এক আম গাছ। আম গাছের গোড়ায় বড় বড় কালো পিপড়ার বাসা। স্থানীয় ভাষায় এগুলো কে বলে ‘ডাইয়া’। মেজরের চোখ পরে ঐ গাছের দিকে। মজিদ মাস্টারকে ওই আম গাছের সাথে বেঁধে রেখে ওরা রওনা হয় মজিদ মাস্টারের বাড়ির পথে। বাড়িতে অপেক্ষা করছে হেনা।নতুন বিয়ে হয়েছে বলে সারাক্ষণ মজিদের প্রতি একটা আকর্ষণ কাজ করে হেনার মনে।কিছুক্ষণ পর পরই মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছা করে। দুপুর হলেই সে গোসল সেরে চোখে কাজল দেয়।খোপায় একটা জবা গেথে নিয়ে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।জালাল রাজাকার হয়তো সুন্দর করে দরজায় কড়া নাড়বে।হেনা দ্রুত দরজা খুলে দিবে। সে দরজা খুলে মজিদ মাস্টারকে দেখতে পাবে না। দিনের আলোতেও দেখতে পাবে পৃথিবীর জমাট বাধা অন্ধকার। মজিদ মাস্টারের সারা শরীরে ডাইয়া কামড়াতে শুরু করে। এই পিপড়া একবার কামড় বসালে সেই ব্যাথা কমে আসতে ঘন্টা খানিক সময় নেয়।মজিদ মাস্টারের সারা গায়ে অসংখ্য ডাইয়া কামড়াতে শুরু করে। তবু কাঁদতে ভুলে যায় মজিদ মাস্টার।
পরিশিষ্ট -২০১৫ সাল। টিভির সামনে বসে আছে এশা।একটু পরই বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট খেলা শুরু হবে। এশা ওর দাদুকে ডাক দেয়-“ দাদু এসো, খেলা শুরু হবে এখনই।দাদু ধীর পায়ে টিভির সামনে এসে বসেন। তিনি ক্রিকেট বোঝেন না। তবু খেলা শুরু হওয়ার ঠিক মুহুর্তে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকেন।টিভি থেকে তার ঘোলা দৃষ্টি সড়ে না। লাল-সবুজের এক টুকরো পতাকা সামনে রেখে মাশরাফিরা লাইন ধরে দাঁড়ায়। শুরু হয় জাতীয় সংগীত। মজিদ মাস্টারের দাঁড়াতে কষ্ট হয়, এশা তাকে দাঁড়াতে সাহায্য করে। মজিদ মাস্টার ডান হাতটা বুকের বাম পাশে রেখে জাতীয় সংগীত শোনেন। এশা বুঝতে পারে না জাতীয় সংগীত শোনার সময় ওর দাদু এভাবে কাঁদে কেন!